Sunday, June 8, 2014

1 হাজার বছরের বৃদ্ধ এক বৃক্ষের কথা

২ মার্চ ২০০৩-এর আনন্দবাজার পত্রিকার ভিতরের পাতায় বুদ্ধগয়ার বোধিবৃক্ষকে রক্ষার জন্য সংবাদ শিরোনামটা ছিল, ‘বোধিবৃক্ষ রক্ষা করতে ডাক পেলেন বিশেষজ্ঞরা’। সেই সংবাদের ভিত্তিতে শিবশংকর ভারতী নিবন্ধটি রচনা করেছিলেন। যার সংকলন আকারে কিছু অংশ দৈনিক প্রথম আলো ৮ আগষ্ট ২০০৩ সংখ্যায় প্রকাশ করে। রাজগুরু বিজয়ানন্দ মহাথের অন্ত্যেষ্টিকিয়া স্বারক নভেম্বর, ২০০৭ ও অনলাইন তথ্য অবলম্বনে ধম্মইনফো-তে পুণঃ প্রকাশ করা হলো। -সম্পাদক।
 রাজকুমার সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ করেছিলেন প্রায় ২৯ বৎসর বয়সে। কপিলাবস্তু থেকে মহাভারতীয় যুগের গিরিব্রজ (রাজগীর) হয়ে গিয়েছিলেন গয়ের নগরীতে (গয়া)। তারপর উরুবিল্ব (বুদ্ধগয়া) গ্রামে নৈরঞ্জনা (ফল্গু) নদীতীরে মগ্ন হয়েছিলেন তপস্যায়। ছ’বছর কঠিন তপস্যার পর বোধিলাভ করলেন তিনি। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল পঁয়ত্রিশ।  বুদ্ধের সাধনা ও বোধিলাভের স্থান হিসাবে বুদ্ধগয়া এবং বোধিবৃক্ষের কথা আজ আর কারও অজানা নেই। পণ্ডিতদের অনুমান,দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের আমলে ভারতে এসেছিলেন চিনা পরিব্রাজক ফা-হিয়েন। ৪০০-৪১১, মতান্তরে ৪০৫-৪১১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ভারতে ছিলেন। বুদ্ধগয়ার মতো পুণ্য ভূমিতে বুদ্ধদেবের লীলার স্থানগুলিতে সংঘারাম, স্তূপ ইত্যাদি নানা বিষয় দেখে তিনি লিখেছিলেন তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্ত ‘ফো-কো-কি’ নামক গ্রন্থ।  গয়ার বোধিবৃক্ষ। ছবি: ধম্মইনফো  বিল সাহেবের ফা-হিয়েনের ভ্রমণ বৃত্তান্তের ইংরেজি অনুবাদ গ্রন্থের ৩১ অধ্যায়ে ফা-হিয়েন বুদ্ধের সাধনক্ষেত্র এবং বোধিবৃক্ষ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘পশ্চিমদিকে ৪ যোজন গমনের পর আমরা গয়ানগরে উপস্থিত হইলাম। এখানেও নগরটি জনশূন্য ও পরিত্যক্ত। দক্ষিণে ২০ ‘লি’ (সাড়ে ৪ লি-তে ১.০১ মাইল) যাইয়া যে স্থানে বোধিসত্ত্ব ছয় বৎসর ধরিয়া তপস্যা করিয়াছিলেন সেই স্থানে আমরা উপস্থিত হইলাম। এই স্থানটি এখন জঙ্গলাকীর্ণ। এই স্থানের ৩ লি পশ্চিমে আমরা উপস্থিত হইলাম, যেখানে বুদ্ধ স্নান করিবার জন্য নদীতে নামিতেন।  এখান হইতে ২ লি উত্তরে এক বৃক্ষতলে যে স্থানে বুদ্ধদেব পাষাণের উপর বসিয়া পূর্বদিকে চক্ষু নিবদ্ধ রাখিয়া দুগ্ধ ও অন্ন ভক্ষণ করিয়াছিলেন সেই স্থান অবস্থিত। আজও সেই বৃক্ষ ও প্রস্তর সেই স্থানেই অবস্থিত। পাথরটি প্রায় ছয় ফুট চৌকো এবং দুই ফুট উচ্চ। মধ্য ভারতে জলবায়ু এমনই সমতা-বিশিষ্ট নাতিশীতোষ্ণ যে এই স্থানে গাছ হাজার হাজার বৎসর বাঁচিয়া থাকে।...’  পঞ্চম শতাব্দে ফা-হিয়েনের দেখা বোধিবৃক্ষটি যে ছোট ছিল না তা তাঁর কথাতেই বোঝা যায়, ‘...বর্তমানে সেই বৃক্ষই তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিজের ছায়াতলে ঢেকে রেখেছে। রাজা অশোক এই বৃক্ষের ধারে সুউচ্চ একটি প্রাচীর গেঁথে দেন যাতে কেউ এর কোনওরূপ ক্ষতি করতে না পারে।’ (ফা-হিয়েনের দেখা ভারত)  সারনাথের ঐতিহাসিক বোধিবৃক্ষ। সূত্র: outreachecology.com  হিউয়েন সাঙ ৬২৯ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে চিন থেকে যাত্রা শুরু করে ভারত সীমানায় পদার্পণ করেন ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে। তারপর অধ্যয়ন ও ভ্রমণ করতে করতে ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে আসেন মগধে ও নালন্দা বিহারে। সম্ভবত ওই সময়েই তিনি এসেছিলেন বুদ্ধগয়ায়। হিউয়েন সাঙ তাঁর ভারত ভ্রমণ গ্রন্থে (সি-ইউ-কাই) সুন্দর একটি চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন বোধিবৃক্ষ প্রসঙ্গে। হিউয়েন সাঙ লিখেছেন,“বজ্রাসনের উপরের বোধিবৃক্ষটি একটি অশ্বত্থ গাছ (পিপল)। পুরাকালে বুদ্ধের সময়ে গাছটি কয়েকশো ফুট উঁচু ছিল। তারপর একে প্রায়ই কেটে ফেলা হয়েছে। তা সত্ত্বেও এখনও এটি ৪০ থেকে ৫০ ফুট উঁচু। বুদ্ধ এর নীচে বসে সম্যক সম্বোধি বা যথার্থ জ্ঞান লাভ করেন বলে একে জ্ঞানের বৃক্ষ বা বোধিবৃক্ষ বলা হয়। এ গাছের বাকল হলদেটে-সাদা, পাতা গাঢ় সবুজ রঙের। কি শীত কি গ্রীষ্ম কোনও ঋতুতেই এর পাতা ঝরে না। সব সময় সেগুলি তেলতেলে চিকণ। কখনও কোনও হেরফের নেই। কিন্তু প্রত্যেক বছর বুদ্ধের নির্বাণ তারিখটি এলে পাতাগুলি হলদে হয়ে ঝরে পড়ে ও মুহূর্তের মধ্যে আবার নতুন পাতা গজিয়ে ওঠে ও আগের চেহারা ফিরে পায়। এই দিনটিতে বিভিন্ন দেশের রাজারা ও অসংখ্য ধর্মানুরাগী চারদিক থেকে কাতারে কাতারে এসে এখানে জমা হন। বোধিবৃক্ষের পাদদেশ সুগন্ধি জল ও সুরভিত দুধ দিয়ে ধুইয়ে দেওয়া হয়। সবাই স্তবগান করে ফুল ছড়ায়, সুগন্ধি ধূপধূনা জ্বালায়। রাতে মশালের আলোয় জায়গাটি আলোকিত হয়ে ওঠে। নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠান-সহ পূজা ও উপহার নিবেদন করা হয়।’...  বুদ্ধত্ব লাভের পর ভগবান বুদ্ধ কৃতজ্ঞ ছিলেন বোধিবৃক্ষের কাছে, যার নির্মল প্রশান্ত সুশীতল ছায়ায় কেটে গিয়েছিল সাধন জীবনের টানা ছ’টি বছর। পরিব্রাজকের কথায়, ‘...বুদ্ধ যেখানে পায়চারি করেন সেখান থেকে উত্তর রাস্তার বাঁদিকে একটি বড় পাথর আছে। এর উপরে একটি বুদ্ধের মূর্তি আছে। মূর্তিটি উপরের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে রয়েছে। তথাগত বুদ্ধত্ব লাভের পর ৭ দিন ধরে বোধিবৃক্ষের দিকে ওই ভাবে চেয়ে থাকেন। এই সময় মধ্যে তিনি ক্ষণিকের জন্যও বোধিবৃক্ষ থেকে তাঁর দৃষ্টি সরিয়ে নেননি। এভাবে চেয়ে থেকে তিনি বোধিবৃক্ষকে তাঁর অন্তরের কৃতজ্ঞতা জানান।’...  শ্রীলংকার অনুরাধাপুরে অবস্থিত বোধিবৃক্ষ। ছবি: অনলাইন  রাজা অশোক মগধের সিংহাসনে বসেন ২৭৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, বুদ্ধের দেহত্যাগের ২১৪ বছর পরে। অশোকের মানসিক পরিবর্তনের আগে বোধিবৃক্ষটিকে ধ্বংস করার জন্য সচেষ্ট হলেও তা পরিব্রাজকের কথায়, ‘গাছটি ঠিক আগের মতোই তার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। রাজা সে দৃশ্য দেখে এত অভিভূত হয়ে পড়লেন যে নিজেই তাকে পূজার্ঘ্য নিবেদন করে চললেন।’  এরপর শৈব রাজা শশাঙ্ক বৌদ্ধধর্মের প্রতিপত্তি নাশের জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। তিনিও বোধিবৃক্ষটি কেটে দিলেন ক্রোধবশত। কিন্তু সে বারও বৃক্ষটি রক্ষা পায়। হিউয়েন সাঙের কথায়, ‘রাজা অশোকের শেষ বংশধর মগধরাজ পূণবর্মা এ খবর শুনে দুঃখ পেলেন। কয়েক মাস পরে তিনি গাছের শিকড়গুলিতে এক হাজার গরুর দুধ ঢাললেন।...গাছটি আবার গজিয়ে ১০ ফুটের মতো লম্বা হয়ে গেল। পাছে আবার কেটে ফেলা হয় সেই ভয়ে তিনি তার চারদিকে ২৪ ফুট উঁচু পাথরের দেওয়াল তুলে দিলেন। গাছটি এখন ২০ ফুট উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা।’  রাজা অশোক তাঁর রাজত্বকালেই বোধিবৃক্ষের একটি শাখা কেটে তাঁর প্রিয় কন্যা ভিক্ষুণী সঙ্ঘমিত্রাকে দিয়ে পাঠালেন সিংহলে। এর প্রাচীন রাজধানী অনুরাধাপুরে রোপিত হল বোধিবৃক্ষের শাখা। অসংখ্য শাখা-প্রশাখায় সে বৃক্ষ বেড়ে উঠল ধীরে ধীরে।  ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের কথা। বৌদ্ধধর্ম প্রসারের প্রচেষ্টায় মহাবোধি সোসাইটি স্থাপন করলেন আচার্য অনাগারিক ধর্মপাল। তিনি অনুরাধাপুর বিহার থেকে বোধিবৃক্ষের একটি শাখা কেটে আনেন সারনাথে। রোপণ করেন মূলগন্ধকুটি বিহারের পূর্ব প্রাঙ্গণে। সেই বৃক্ষটি আজ বেশ বড় আকার ধারণ করেছে। বুদ্ধগয়ার বোধিবৃক্ষটি এক বার প্রবল ঝড়ে উৎপাটিত হয় ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে। পরে একই জায়গায় রোপণ করা হয় বৃক্ষটিকে।  ১৬ মে ১৯২৭—১ ডিসেম্বর ১৯২৮, এই উনিশ মাস লঙ্কাতে ছিলেন রাহুল সাংকৃত্যায়ন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে তিনিও দেখেছিলেন বোধিবৃক্ষটি। ‘আমার জীবন যাত্রা’ গ্রন্থে এক জায়গায় লিখেছেন, ‘...অনুরাধাপুর হল লঙ্কার পুরনো রাজধানী। এখান থেকেই লঙ্কার ইতিহাস শুরু হয়েছে এবং বৌদ্ধধর্মেরও। প্রথম বৌদ্ধধর্ম প্রচারক অশোকপুত্র খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে এখানেই ধর্মের পতাকা পুঁতেছিলেন।...আমরা এ-দিক ও-দিক ঘুরতে ঘুরতে বোধিবৃক্ষের নীচে পৌঁছলাম। ওখানে কয়েকশো বৈদ্যুতিক আলো জ্বলছিল। অশোক কন্যা ভিক্ষুণী সঙ্ঘমিত্রা বুদ্ধগয়ার অশ্বত্থ গাছের একটি শাখা নিয়ে এসেছিলেন, এটি সেই ঐতিহাসিক বৃক্ষ—এই বলে রাজেন্দ্রবাবুকে আমি গাছটির বৈশিষ্ট্যের কথা জানালাম। তাতে তিনি বললেন, ‘এই শাখা বুদ্ধগয়ার অশ্বত্থগাছের, যার জন্য বিশেষ উপায়ে ইঞ্জিন রেখে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর আমাদের ওখানে মূল বোধিবৃক্ষটির যে কি কদর সে আমরা জানি।  হাজার হাজার বছর ধরে রোদ, ঝড়, জল উপেক্ষা আর মানুষের অত্যাচার সহ্য করে বুদ্ধগয়া, অনুরাধাপুর, সারনাথ এবং সাঁচীতে চতুর্থ প্রজন্মের বোধিবৃক্ষ আজও দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে, থাকবে অনাগত ভবিষ্যতেও, ভগবান বুদ্ধকে স্মরণ করে।

- See more at: http://dhammainfo.com
২ মার্চ ২০০৩-এর আনন্দবাজার পত্রিকার ভিতরের পাতায় বুদ্ধগয়ার বোধিবৃক্ষকে রক্ষার জন্য সংবাদ শিরোনামটা ছিল, বোধিবৃক্ষ রক্ষা করতে ডাক পেলেন বিশেষজ্ঞরা। সেই সংবাদের ভিত্তিতে শিবশংকর ভারতী নিবন্ধটি রচনা করেছিলেন। যার সংকলন আকারে কিছু অংশ দৈনিক প্রথম আলো ৮ আগষ্ট ২০০৩ সংখ্যায় প্রকাশ করে। রাজগুরু বিজয়ানন্দ মহাথের অন্ত্যেষ্টিকিয়া স্বারক নভেম্বর, ২০০৭ ও অনলাইন তথ্য অবলম্বনে ধম্মইনফো-তে পুণঃ প্রকাশ করা হলো। -সম্পাদক।
রাজকুমার সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ করেছিলেন প্রায় ২৯ বৎসর বয়সে। কপিলাবস্তু থেকে মহাভারতীয় যুগের গিরিব্রজ (রাজগীর) হয়ে গিয়েছিলেন গয়ের নগরীতে (গয়া)। তারপর উরুবিল্ব (বুদ্ধগয়া) গ্রামে নৈরঞ্জনা (ফল্গু) নদীতীরে মগ্ন হয়েছিলেন তপস্যায়। ছবছর কঠিন তপস্যার পর বোধিলাভ করলেন তিনি। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল পঁয়ত্রিশ।
বুদ্ধের সাধনা ও বোধিলাভের স্থান হিসাবে বুদ্ধগয়া এবং বোধিবৃক্ষের কথা আজ আর কারও অজানা নেই। পণ্ডিতদের অনুমান,দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের আমলে ভারতে এসেছিলেন চিনা পরিব্রাজক ফা-হিয়েন। ৪০০-৪১১, মতান্তরে ৪০৫-৪১১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ভারতে ছিলেন। বুদ্ধগয়ার মতো পুণ্য ভূমিতে বুদ্ধদেবের লীলার স্থানগুলিতে সংঘারাম, স্তূপ ইত্যাদি নানা বিষয় দেখে তিনি লিখেছিলেন তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্ত ফো-কো-কি নামক গ্রন্থ।
গয়ার বোধিবৃক্ষ। ছবি: ধম্মইনফো
বিল সাহেবের ফা-হিয়েনের ভ্রমণ বৃত্তান্তের ইংরেজি অনুবাদ গ্রন্থের ৩১ অধ্যায়ে ফা-হিয়েন বুদ্ধের সাধনক্ষেত্র এবং বোধিবৃক্ষ প্রসঙ্গে বলেছেন, পশ্চিমদিকে ৪ যোজন গমনের পর আমরা গয়ানগরে উপস্থিত হইলাম। এখানেও নগরটি জনশূন্য ও পরিত্যক্ত। দক্ষিণে ২০ লি (সাড়ে ৪ লি-তে ১.০১ মাইল) যাইয়া যে স্থানে বোধিসত্ত্ব ছয় বৎসর ধরিয়া তপস্যা করিয়াছিলেন সেই স্থানে আমরা উপস্থিত হইলাম। এই স্থানটি এখন জঙ্গলাকীর্ণ। এই স্থানের ৩ লি পশ্চিমে আমরা উপস্থিত হইলাম, যেখানে বুদ্ধ স্নান করিবার জন্য নদীতে নামিতেন।
এখান হইতে ২ লি উত্তরে এক বৃক্ষতলে যে স্থানে বুদ্ধদেব পাষাণের উপর বসিয়া পূর্বদিকে চক্ষু নিবদ্ধ রাখিয়া দুগ্ধ ও অন্ন ভক্ষণ করিয়াছিলেন সেই স্থান অবস্থিত। আজও সেই বৃক্ষ ও প্রস্তর সেই স্থানেই অবস্থিত। পাথরটি প্রায় ছয় ফুট চৌকো এবং দুই ফুট উচ্চ। মধ্য ভারতে জলবায়ু এমনই সমতা-বিশিষ্ট নাতিশীতোষ্ণ যে এই স্থানে গাছ হাজার হাজার বৎসর বাঁচিয়া থাকে।...
পঞ্চম শতাব্দে ফা-হিয়েনের দেখা বোধিবৃক্ষটি যে ছোট ছিল না তা তাঁর কথাতেই বোঝা যায়, ...বর্তমানে সেই বৃক্ষই তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিজের ছায়াতলে ঢেকে রেখেছে। রাজা অশোক এই বৃক্ষের ধারে সুউচ্চ একটি প্রাচীর গেঁথে দেন যাতে কেউ এর কোনওরূপ ক্ষতি করতে না পারে। (ফা-হিয়েনের দেখা ভারত)
সারনাথের ঐতিহাসিক বোধিবৃক্ষ। সূত্র: outreachecology.com
হিউয়েন সাঙ ৬২৯ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে চিন থেকে যাত্রা শুরু করে ভারত সীমানায় পদার্পণ করেন ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে। তারপর অধ্যয়ন ও ভ্রমণ করতে করতে ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে আসেন মগধে ও নালন্দা বিহারে। সম্ভবত ওই সময়েই তিনি এসেছিলেন বুদ্ধগয়ায়। হিউয়েন সাঙ তাঁর ভারত ভ্রমণ গ্রন্থে (সি-ইউ-কাই) সুন্দর একটি চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন বোধিবৃক্ষ প্রসঙ্গে। হিউয়েন সাঙ লিখেছেন,বজ্রাসনের উপরের বোধিবৃক্ষটি একটি অশ্বত্থ গাছ (পিপল)। পুরাকালে বুদ্ধের সময়ে গাছটি কয়েকশো ফুট উঁচু ছিল। তারপর একে প্রায়ই কেটে ফেলা হয়েছে। তা সত্ত্বেও এখনও এটি ৪০ থেকে ৫০ ফুট উঁচু। বুদ্ধ এর নীচে বসে সম্যক সম্বোধি বা যথার্থ জ্ঞান লাভ করেন বলে একে জ্ঞানের বৃক্ষ বা বোধিবৃক্ষ বলা হয়। এ গাছের বাকল হলদেটে-সাদা, পাতা গাঢ় সবুজ রঙের। কি শীত কি গ্রীষ্ম কোনও ঋতুতেই এর পাতা ঝরে না। সব সময় সেগুলি তেলতেলে চিকণ। কখনও কোনও হেরফের নেই। কিন্তু প্রত্যেক বছর বুদ্ধের নির্বাণ তারিখটি এলে পাতাগুলি হলদে হয়ে ঝরে পড়ে ও মুহূর্তের মধ্যে আবার নতুন পাতা গজিয়ে ওঠে ও আগের চেহারা ফিরে পায়। এই দিনটিতে বিভিন্ন দেশের রাজারা ও অসংখ্য ধর্মানুরাগী চারদিক থেকে কাতারে কাতারে এসে এখানে জমা হন। বোধিবৃক্ষের পাদদেশ সুগন্ধি জল ও সুরভিত দুধ দিয়ে ধুইয়ে দেওয়া হয়। সবাই স্তবগান করে ফুল ছড়ায়, সুগন্ধি ধূপধূনা জ্বালায়। রাতে মশালের আলোয় জায়গাটি আলোকিত হয়ে ওঠে। নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠান-সহ পূজা ও উপহার নিবেদন করা হয়।...
বুদ্ধত্ব লাভের পর ভগবান বুদ্ধ কৃতজ্ঞ ছিলেন বোধিবৃক্ষের কাছে, যার নির্মল প্রশান্ত সুশীতল ছায়ায় কেটে গিয়েছিল সাধন জীবনের টানা ছ’টি বছর। পরিব্রাজকের কথায়, ‘...বুদ্ধ যেখানে পায়চারি করেন সেখান থেকে উত্তর রাস্তার বাঁদিকে একটি বড় পাথর আছে। এর উপরে একটি বুদ্ধের মূর্তি আছে। মূর্তিটি উপরের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে রয়েছে। তথাগত বুদ্ধত্ব লাভের পর ৭ দিন ধরে বোধিবৃক্ষের দিকে ওই ভাবে চেয়ে থাকেন। এই সময় মধ্যে তিনি ক্ষণিকের জন্যও বোধিবৃক্ষ থেকে তাঁর দৃষ্টি সরিয়ে নেননি। এভাবে চেয়ে থেকে তিনি বোধিবৃক্ষকে তাঁর অন্তরের কৃতজ্ঞতা জানান।’...
শ্রীলংকার অনুরাধাপুরে অবস্থিত বোধিবৃক্ষ। ছবি: অনলাইন
রাজা অশোক মগধের সিংহাসনে বসেন ২৭৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, বুদ্ধের দেহত্যাগের ২১৪ বছর পরে। অশোকের মানসিক পরিবর্তনের আগে বোধিবৃক্ষটিকে ধ্বংস করার জন্য সচেষ্ট হলেও তা পরিব্রাজকের কথায়, ‘গাছটি ঠিক আগের মতোই তার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। রাজা সে দৃশ্য দেখে এত অভিভূত হয়ে পড়লেন যে নিজেই তাকে পূজার্ঘ্য নিবেদন করে চললেন।’
এরপর শৈব রাজা শশাঙ্ক বৌদ্ধধর্মের প্রতিপত্তি নাশের জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। তিনিও বোধিবৃক্ষটি কেটে দিলেন ক্রোধবশত। কিন্তু সে বারও বৃক্ষটি রক্ষা পায়। হিউয়েন সাঙের কথায়, ‘রাজা অশোকের শেষ বংশধর মগধরাজ পূণবর্মা এ খবর শুনে দুঃখ পেলেন। কয়েক মাস পরে তিনি গাছের শিকড়গুলিতে এক হাজার গরুর দুধ ঢাললেন।...গাছটি আবার গজিয়ে ১০ ফুটের মতো লম্বা হয়ে গেল। পাছে আবার কেটে ফেলা হয় সেই ভয়ে তিনি তার চারদিকে ২৪ ফুট উঁচু পাথরের দেওয়াল তুলে দিলেন। গাছটি এখন ২০ ফুট উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা।’
রাজা অশোক তাঁর রাজত্বকালেই বোধিবৃক্ষের একটি শাখা কেটে তাঁর প্রিয় কন্যা ভিক্ষুণী সঙ্ঘমিত্রাকে দিয়ে পাঠালেন সিংহলে। এর প্রাচীন রাজধানী অনুরাধাপুরে রোপিত হল বোধিবৃক্ষের শাখা। অসংখ্য শাখা-প্রশাখায় সে বৃক্ষ বেড়ে উঠল ধীরে ধীরে।
১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের কথা। বৌদ্ধধর্ম প্রসারের প্রচেষ্টায় মহাবোধি সোসাইটি স্থাপন করলেন আচার্য অনাগারিক ধর্মপাল। তিনি অনুরাধাপুর বিহার থেকে বোধিবৃক্ষের একটি শাখা কেটে আনেন সারনাথে। রোপণ করেন মূলগন্ধকুটি বিহারের পূর্ব প্রাঙ্গণে। সেই বৃক্ষটি আজ বেশ বড় আকার ধারণ করেছে। বুদ্ধগয়ার বোধিবৃক্ষটি এক বার প্রবল ঝড়ে উৎপাটিত হয় ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে। পরে একই জায়গায় রোপণ করা হয় বৃক্ষটিকে।
১৬ মে ১৯২৭—১ ডিসেম্বর ১৯২৮, এই উনিশ মাস লঙ্কাতে ছিলেন রাহুল সাংকৃত্যায়ন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে তিনিও দেখেছিলেন বোধিবৃক্ষটি। ‘আমার জীবন যাত্রা’ গ্রন্থে এক জায়গায় লিখেছেন, ‘...অনুরাধাপুর হল লঙ্কার পুরনো রাজধানী। এখান থেকেই লঙ্কার ইতিহাস শুরু হয়েছে এবং বৌদ্ধধর্মেরও। প্রথম বৌদ্ধধর্ম প্রচারক অশোকপুত্র খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে এখানেই ধর্মের পতাকা পুঁতেছিলেন।...আমরা এ-দিক ও-দিক ঘুরতে ঘুরতে বোধিবৃক্ষের নীচে পৌঁছলাম। ওখানে কয়েকশো বৈদ্যুতিক আলো জ্বলছিল। অশোক কন্যা ভিক্ষুণী সঙ্ঘমিত্রা বুদ্ধগয়ার অশ্বত্থ গাছের একটি শাখা নিয়ে এসেছিলেন, এটি সেই ঐতিহাসিক বৃক্ষ—এই বলে রাজেন্দ্রবাবুকে আমি গাছটির বৈশিষ্ট্যের কথা জানালাম। তাতে তিনি বললেন, ‘এই শাখা বুদ্ধগয়ার অশ্বত্থগাছের, যার জন্য বিশেষ উপায়ে ইঞ্জিন রেখে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর আমাদের ওখানে মূল বোধিবৃক্ষটির যে কি কদর সে আমরা জানি।
হাজার হাজার বছর ধরে রোদ, ঝড়, জল উপেক্ষা আর মানুষের অত্যাচার সহ্য করে বুদ্ধগয়া, অনুরাধাপুর, সারনাথ এবং সাঁচীতে চতুর্থ প্রজন্মের বোধিবৃক্ষ আজও দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে, থাকবে অনাগত ভবিষ্যতেও, ভগবান বুদ্ধকে স্মরণ করে।
- See more at: http://dhammainfo.com/heritage/india/1459#sthash.GzgPMRUb.dpuf

1 comments:

  1. The article is excellent. I'm going to use some of the information in an article of mine. Just now, th pictures are not visible. May be due to temporary problem in server.

    ReplyDelete