Thursday, December 12, 2013

0 বৌদ্ধধর্ম অনুশীলনের ধর্ম, আচরণের ধর্ম এবং বাস্তব দর্শনের ধর্ম

ধর্ম চর্চা নিয়ে বলতে গেলে সর্বপ্রথমে ধর্ম শব্দের তাৎপর্য নিয়ে বিবেচনাকরাটা সমীচীন । ইংরেজি Religion শব্দের উৎপত্তি Latin শব্দ Religio (n) / Religare (v) থেকে। এর অর্থ সম্পর্ক (relation), বন্ধন (binding), যোগাযোগ (connection) । বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, যে সকল ধর্ম ঈশ্বর, সৃষ্টিকর্তা-রপ্রতি বিশ্বাস রাখে (Atheist), তারা তাদের দৈনন্দিন আচার-আচরন ওঅনুষ্ঠানাদির মধ্যদিয়ে সেই সৃষ্টিকর্তার সাথে একটা সম্পর্ক কিম্বা যোগাযোগকরার চেষ্টা করে। এই দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিবেচনা করলে Religion শব্দের উৎপত্তিরযথার্থতা যাচাই করা যায় । এখন প্রশ্ন হছে, যেসব ধর্ম কিম্বা মতবাদ ঈশ্বরসম্পর্কে উদাসীন কিম্বা অস্তিত্ব স্বীকার করেনা (atheist, যেমন বৌদ্ধধর্ম), সেসব মতবাদকে কি ধর্ম বলা যাবে না? গৌতম বুদ্ধের অনুসারীরা তাঁর দেশিতচতুরার্য সত্যের মূল কথা “দুঃখ” থেকে মুক্তি পাবার লক্ষ্যে আর্য অষ্টাঙ্গিকমার্গ অনুশীলন ও পালন করে নির্বাণ লাভের প্রয়াস করে। অর্থাৎ বৌদ্ধরা তাদেরদৈনন্দিন জীবন যাত্রার মাধ্যমে বুদ্ধের দেশিত বাণী অনুসরণ করে নির্বাণলাভের সাথে একটা সম্পর্ক সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা চালায় বলে বৌদ্ধ ধর্মকেধর্ম বলে অবিহিত করা যায়।আবার বাংলায় “ধর্ম” বলতে আমরা বুঝি – কোনপ্রাণী বা বস্তুর সহজাত প্রবৃত্তি বা গুণগত বৈশিষ্ট্য এবং সেই হিসেবেবিভিন্ন প্রাণী, বস্তু কিম্বা ধাতুকে আমরা সংজ্ঞায়িত করি । এ সংজ্ঞায় আমরামানুষের ধর্ম বলতে কি বুঝি? আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও গুণগত মানই বাকিরূপ হওয়া উচিৎ, তা ভেবে দেখার বিষয় ।বুদ্ধ মানুষের মনুষ্যত্ব বিকাশের এবং আত্মশুদ্ধির জন্য ব্রহ্ম বিহারের (sublime state) কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন । মানুষের গুণগত মান উন্নয়ন ও আত্মশুদ্ধির জন্য মৈত্রী (loving kindness), করুণা (compassion), মুদিতা (altruistic or sympathetic joy), ও উপেক্ষা (equanimity), এই চারি প্রকার ব্রহ্ম বিহার-এর অনুশীলনকরা একান্ত অপরিহার্য । অন্যের সুখে আনন্দিত কিম্বা সুখ প্রকাশ করা (মুদিতা) যেমন উন্নত মনের পরিচায়ক তেমনি যা যেমন তা ঠিক তেমনি ভাবে দেখা (উপেক্ষা) অর্থাৎ সুখে অধিক বিমোহিত না হয়ে কিম্বা দুঃখে মোটেই কাতর বাবিচলিত না হয়ে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিয়ে একে চিরন্তন সত্য বলে মনে করামানসিক উৎকর্ষতার পরিচায়ক ।চতুরার্য সত্যের “দুঃখ” শব্দটা যেমনবাংলায় কষ্ট বলে ব্যাখ্যা করা হয়, তেমনি ইংরেজিতে এর আক্ষরিক অনুবাদ করাহয়েছে “sorrows” বলে । এ কারণে বুদ্ধধর্মকে অনেকে ‘দুঃখবাদ’ বা নৈরাশ্যবাদী (pessimistic) ধর্ম বলে আখ্যায়িত করে । বস্থুত, বুদ্ধ “দুঃখ” শব্দটা দিয়েবোঝাতে চেয়েছেন – নশ্বর কিম্বা ক্ষণস্থায়ী (impermanence), অসম্পূর্ণ (imperfection), শূন্যতা (emptiness) ইত্যাদি ধারণার মাধ্যমে । বুদ্ধ যেমনঅতিরিক্ত আশা বা আতিশয্যের প্রলোভন দেখিয়ে তাঁর দেশিত ধর্মের দিকে কাউকেআকৃষ্ট করাতে চাননি (optimistic), তেমনি নৈরাশ্যবাদী বলে কাউকে হতাশ করতেওচাননি । বুদ্ধ যা যেমন সেটাকে ঠিক সেভাবেই দেখতে বলেছেন (yathâ bhûtaṃ) ।এক কথায়, বুদ্ধধর্ম pessimistic কিম্বা optimistic ধর্ম নয় বরং এটা একটা realistic ধর্ম । এই প্রসঙ্গে কোন কোন বৌদ্ধমনীষা উদাহরণ স্বরূপ বলেছেন, কোন ডাক্তার এক রুগীকে দেখে রোগের প্রকারকে অতিরঞ্জিত করে সেই রোগ সাড়ার নয়বলে রুগীকে জবাব দিয়ে দেন; আবার অন্য ডাক্তার নিজের অজ্ঞতা বশত ওই রুগীরোগবিহীন বলে কোন চিকিৎসার প্রয়োজন নেই বলে উড়িয়ে দেন । এক্ষেত্রে প্রথমডাক্তারকে pessimistic এবং পরের জনকে optimistic বলা যায় । এদের দুজনই খুবইভয়ংকর । অপরপক্ষে, তৃতীয় ডাক্তার সঠিক রোগ নির্ণয় করে, এর কারণ এবং ধরণবুঝে এই রোগ নিরাময় যোগ্য বলে স্থির করে সঠিক অষুধ দিয়ে রোগ সারিয়ে রোগীকেরোগমুক্ত করিয়ে জীবন বাঁচিয়ে দেন । ইনি হচ্ছেন একজন realistic ডাক্তার ।বুদ্ধ মানবজীবনের দুঃখ, অশান্তি ও কষ্টের মূল সমস্যা কোথায় তার সন্ধানদিয়েছেন চতুরার্য সত্য সন্ধানের মাধ্যমে এবং এই অশান্তি থেকে মুক্তির পথ (মার্গ) দেখিয়েছেন আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ (eightfold path) অনুসরণের মধ্যদিয়ে । তাই বুদ্ধ একজন realistic ডাক্তার এবং বৌদ্ধধর্ম একটি realistic ধর্ম ।
লক্ষ্যনীয় বিষয় যে, এই আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের একটাক্রমিক বিকাশ আছে এবং এই আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ হল চতুরার্য সত্যের চতুর্থসত্য, “দুঃখ মুক্তির উপায় (মার্গ বা পথ)” । প্রথম মার্গ, ‘সম্যক দৃষ্টি’ হলচারটি আর্যসত্য সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান । ‘সম্যক দৃষ্টি’ দিয়ে ‘দুঃখ’ (চতুরার্য সত্যের প্রথম সত্য)-কে অনুধাবন করে সর্বপ্রথম আমাদের ‘অবিদ্যা’ বা ‘অজ্ঞতা্’-কে জয় করতে হবে । কারণ, এই অজ্ঞতা্ বা অবিদ্যা-কেই বুদ্ধদুঃখের প্রধান উৎস হিসাবে চিহ্নিত করেছেন । এই অজ্ঞতা্র কারণেই মানুষবস্তুর প্রতি আকৃষ্ট হয় ও এতে আসক্তি জন্মে । এর ফলে আমরা ভোগবিলাস, কামনা-বাসনা, মোহ, হিংসা, রাগ-দ্বেষ এসবে লিপ্ত হয়ে পড়ি । ‘সম্যক সংকল্প’ (দ্বিতীয় মার্গ) অনুসরণ করে এসব আসক্তি থেকে বিরত থাকতে হবে । এভাবে আটপ্রকার মার্গগুলো ক্রম অনুসারে অনুসরণ করে ‘সম্যক সমাধি’-র (সর্বশেষ বাঅষ্টম মার্গ) মধ্য দিয়ে আমরা নর্বাণ পথযাত্রী হতে পারি ।বৌদ্ধধর্ম অনুশীলনের ধর্ম, আচরণের ধর্ম (âchariya dhamma), দৈনন্দিন জীবনধারণের (a way of life) ধর্ম, ব্যবহারের ধর্ম, এবং বাস্তব দর্শনের ধর্ম ।এই ধর্মে অলৌকিক, কিম্বা অপার্থিব কোন কিছুরই স্থান নেই । যা বাস্তব, যাসত্য, যা চোখের সামনে দেখা যায় কিম্বা উপলব্দি করা যায় তাই বৌদ্ধধর্ম ।বুদ্ধ তাঁর দেশিত ধর্ম সম্পর্কে বলেছেন, ‘এহি পসসিক’ – ‘এসো এবং দেখো’, এসোএবং বিশ্বাস করো নয় । বুদ্ধ তাঁর কালাম (Kâlâma) সুত্রে বলেছেন, অন্ধভাবেকোন কিছু বিশ্বাস না করতে, শোনা কথায় কান না দিয়ে সত্যতা বিচার করে তাগ্রহণ করতে, যুগ যুগ ধরে যে মতবাদ চলে আসছে কিম্বা বুদ্ধ বলেছেন বলেই যেবিশ্বাস করতে হবে বা মেনে নিতে হবে তা নয়। যুক্তিতর্ক ও বাস্তবতারভিত্তিতেই সত্যকে গ্রহণ করতে বলেছেন তিনি ।

সহযোগী গ্রন্থঃ
১. বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন – ড. দ্বীজেন বড়ুয়া
২. ড. বসুমিত্র বড়ুয়ার গবেষনালব্দ Article এর খন্ডিত অংশ ।
৩. Buddhism & Comical World এর ২৭ পৃষ্ঠার গুরত্বপুর্ন অংশ ।
Written by  সুনয়ন বড়ুয়া (এস.নয়ন )

ছবি এবং তথ্যসূত্র:http://www.nirvanapeace.com

0 comments:

Post a Comment