Wednesday, April 30, 2014

0 বৌদ্ধধর্মে প্রতীত্যসমুৎপাদ

বৌদ্ধধর্মে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে প্রতীত্যসমুৎপাদ। এই প্রতীত্যসমুৎপাদ শব্দটির বিশ্লেষণ বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে উক্ত হয়েছে- ক. প্রতীত্য+সম+উপ্পাদ = প্রতীত্যসমুৎপাদ, এক্ষেত্রে ‘প্রতীত্য’ শব্দের অর্থ কারণ যেটি ‘সম’ (যার অর্থ যথার্থ বা উপযুক্ত) এর উপর নির্ভর করে। আর ‘উপ্পাদ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে উৎপাদিত বা সংগঠিত। এক্ষেত্রে প্রতীত্যসমুৎপাদ শব্দের অর্থ হচ্ছে কারণ দ্বারা সংগঠিত বা উৎপাদিত। খ. পটিচ্চ = কারণ, কারণ + সমুপ্পাদ = উৎপত্তির সংযোগ সূত্র, সমুপ্পন্ন = উৎপাদিত বা অস্তিত্বে আগমন। গ. প্রতীত্য + সমুৎপাদ = প্রতীত্যসমুৎপাদ, এখানে ‘প্রতীত্য’ অর্থ কার্যকারণ বশতঃ এবং ‘সমুৎপাদ’ শব্দের অর্থ উৎপত্তি। মূলতঃ পালি ‘পটিচ্চসমুপ্পাদ’ শব্দকে বাংলায় প্রতীত্যসমুৎপাদ বলা হয়। সংক্ষেপে প্রতীত্যসমুৎপাদ শব্দের অর্থ কারণজনক উৎপত্তি। মধ্যম নিকায়ের ঔপম্যবর্গের আর্য্যপর্য্যষেণ সূত্রে উল্লেখ আছে- সিদ্ধার্থ গৌতম ২৯ বছর বয়সে গৃহত্যাগ করে মুক্তির পথ অন্বেষণে পর্যায়ক্রমে আরাড় কালাম, রুদ্র রামপুত্র প্রমুখ তৎকালীন বড় বড় মনীষীদের কাছে দুঃখ মুক্তির যথার্থ পথ না পেয়ে দীর্ঘ ছয় বছর ধরে নিজেই কঠোর তপস্যা করলেন।
সাধনার সমাপনান্তে তিনি গভীর দুদ্দর্শ, দুরনুবোধ্য, শান্ত, প্রণীত, তর্কাতীত, নিপুণ, পন্ডিত বেদনীয় ধর্মের দুই তত্ত্ব আয়ত্ব করেছিলেন। ১. হেতুপ্রত্যয়তা প্রতীত্যসমুৎপাদ ২. সর্বসংস্কার শমথ, সর্বউপাধি-পরিবর্জিত, তৃষ্ণাক্ষয় বিরাগ ও নিরোধ(নামধেয়) নির্বাণ। হেতু প্রত্যয়তা অর্থে কারণবশত। আবার, মধ্যম নিকায়ের মহাযমক বর্গের মহা তৃষ্ণাসংক্ষয় সূত্রানুসারে- ‘ইমস্মিং সতি ইদং হোতি, ইমস্সুপ্পাদা ইদং উপ্পজ্জতি, ইমস্মিং অসতি ইদং ন হোতি, ইমস্স নিরোধা ইদং নিরুজ্ঝতি।’ অর্থাৎ, উহা থাকলে ইহা হয়, উহার উৎপত্তিতে ইহার উৎপত্তি হয়। উহা না থাকলে ইহা হয়না, উহার নিরোধে ইহার নিরোধ হয়। বিস্তৃতার্থে- অবিদ্যা হেতু সংস্কার, সংস্কার হেতু বিজ্ঞান, বিজ্ঞান হেতু নাম-রূপ, নাম-রূপ হেতু ষড়ায়তন, ষড়ায়তন হেতু স্পর্শ, স্পর্শের হেতু বেদনা, বেদনা হেতু তৃষ্ণা, তৃষ্ণা হেতু উপাদান, উপাদান হেতু ভব, ভব হেতু জাতি(জন্ম), জাতি হেতু জরা, মরণ, শোক, পরিদেবন, দুঃখ, দৌর্মনস্য ও নৈরাশ্য প্রভৃতি উৎপন্ন হয়। মহাতৃষ্ণাসংক্ষয় সূত্রে আরো উল্লেখ আছে- ইমস্মিং অসতি ইদং ন হোতি, ইমস্স নিরোধা ইদং নিরুজ্ঝতীতি। অর্থাৎ, ইহা বিদ্যমান না থাকলে তাহা হয় না, ইহার নিরোধে তাহা নিরুদ্ধ হয়। অবিদ্যা নিরোধে সংস্কার নিরোধ, সংস্কার নিরোধে বিজ্ঞান নিরোধ, বিজ্ঞান নিরোধে নাম-রূপ নিরোধ, নামরূপ নিরোধে ষড়ায়তন নিরোধ, ষড়ায়তন নিরোধে স্পর্শ নিরোধ, স্পর্শের নিরোধে বেদনা নিরোধ, বেদনা নিরোধে তৃষ্ণা নিরোধ, তৃষ্ণা নিরোধে উপাদান নিরোধ, উপাদান নিরোধে ভব নিরোধ, ভব নিরোধে জাতি নিরোধ, জাতি নিরোধে জরা, মরণ, শোক, পরিদেবন, দুঃখ, দৌর্মনস্য ও নৈরাশ্য নিরুদ্ধ হয়। এইরূপে সমগ্র দুঃখ স্কন্ধের নিরোধ হয়। উদান গ্রন্থের বোধিসূত্রানুসারে, উদ্ধৃত হেতুপ্রত্যয়তার প্রথমাংশকে (উৎপত্তি) অনুলোম দেশনা এবং পরের অংশকে(নিরোধ) প্রতিলোম দেশনা নামে উল্লেখ করা হয়েছে। শুধুমাত্র অনুলোমই প্রতিত্যসমুৎপাদের মূল সূত্র নাকি অনুলোম ও প্রতিলোম একত্রে প্রতীত্যসমুৎপাদের মূল দেশনা তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া যায়। আর্য্যপর্য্যেষণ সূত্রে উৎপত্তি ও নিরোধকে আলাদা আলাদা ভাবে দেখানো হয়েছে।
আবার অভিধম্ম পিটকের ‘বিভঙ্গ’ গ্রন্থে ‘প্রতিত্য-সমুৎপাদ বিভঙ্গ’ এর বিশদ বর্ণনায় কেবলমাত্র উৎপত্তিরই বর্ণনা পাওয়া যায়। বুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভ করে ১ম এক সপ্তাহ বোধিপালঙ্কে কাটিয়ে দেন। সেখানে প্রথম রাত্রিতে প্রতীত্যসমুৎপাদের অনুলোম, প্রতিলোম দুটোই তিনি পর্যালোচনা করেন। প্রতীত্যসমুৎপাদ নীতি প্রসঙ্গে বিখ্যাত বিজ্ঞানী নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আবিষ্কারের ঘটনাটিকে আমরা উদাহরণ হিসেবে নিতে পারি- আপেল বৃক্ষ হতে আপেলের নিম্নদিকে পতন দেখে নিউটনের মনে প্রশ্ন জেগেছিল; আপেল সরাসরি নিচের দিকে পড়ে কেন, এটি উপরদিকে কিংবা বামে ডানে কোনদিকে যায় না কেন। তার এই আত্মজিজ্ঞাসা স্বীয় দৃষ্টি এবং চিন্তা চেতনায় প্রবলভাবে নাড়া দেয়। আর তারই ফলশ্রুতিতে আবিষ্কৃত হয় ‘মাধ্যাকর্ষণ শক্তি’। অর্থাৎ পৃথিবীর আকর্ষণের কারণেই আপেল নিচের দিকে পতিত হয়। তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধের আবির্ভাব ঘটুক বা না ঘটুক, জন্ম, জরা, ব্যাধি, মরণের ঘটনা ঘটছে এবং ঘটবে। এটি কার্য্যকারণ নীতি কিংবা প্রতীত্যসমুৎপাদ নীতিতে চক্রাধীন। তথাগত বুদ্ধ এই চক্র উদ্ভাবন করে দুঃখে জর্জরিত সত্ত্বগণকে দুঃখ থেকে চির মুক্তির পথ দেখিয়ে গেছেন। সৃষ্টিকর্তার খেলা, লীলাময়ের লীলা, ইচ্ছাময়ের ইচ্ছা কিংবা অদৃশ্য শক্তির দোহাই দিয়ে খেয়ালখুশীমত কোন অজুহাতের স্থান নেই। একটা সময় ছিল মানুষ জোঁয়ার-ভাটাকে অদৃশ্যকর্র্তার খেলা বা শক্তি প্রদর্শন হিসেবেই জানত। পরে ইহার কারণ খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেলেন চন্দ্রের আকর্ষণকে। যতদিন পর্যন্ত আকর্ষণের কথা আবিষ্কৃত হয়নি ততদিন জোঁয়ার-ভাটা হওয়াটাকে আশ্চর্য বিষয় হিসেবেই জানা হত। কার্যকারণনীতিও জোয়ার-ভাটা হওয়ার সেই আশ্চর্য বিষয়ের মতো, যেখানে তথাগত বুদ্ধ এই ঘুর্ণায়মান ভবচক্রের কারণ আবিষ্কারক। বিভিন্ন বিষয়ে বিজ্ঞানীরা অজ্ঞাতভাবে এই কার্যকারণনীতিকেই মেনে চলে কেননা তারা প্রতিটি বিষয়েরই সুনির্দিষ্ট প্রমাণ খোজে। এই সুশৃঙ্খল কার্যকারণ নীতি পর্য্যবেক্ষণ এবং প্রমাণযোগ্য।
এখানে আত্মবিশ্বাসের কোনো স্থান নেই এটি আত্ম উপলব্ধির বিষয়। এ নীতিই বিশ্বে তথাগত বুদ্ধের অন্যতম অবদান। অন্যান্য ধর্ম যেখানে এক অদৃশ্য শক্তিকে সর্বোচ্চ আসনে বসিয়ে তার ইচ্ছা বলে সব চালিয়ে দেয় সেখানে তথাগত বুদ্ধের আবিষ্কৃত এই নীতি সব ধর্ম হতে বুদ্ধধর্মকে পৃথক করেছে। এ নীতিতে যাঁরা সামান্যতমও ব্যবহারিক জ্ঞান লাভ করেছেন তারা এক বাক্যে স্বীকার করেছেন বুদ্ধের ধর্মের অতুলনীয় মাহাত্ম্যের কথা। আর যাঁরা এ নীতি দ্বারা সাধনালব্ধ পারমার্থিক জ্ঞান লাভ করেছেন তাদের কথা আর কি বলার থাকতে পারে। প্রতীত্যসমুৎপাদনীতি কে বুঝার সুবিধার্থে ‘পটঠান’ এর ‘অনন্তর পচ্চয়ো’ কে উদাহরণ হিসেবে নেওয়া যেতে পারে। অনন্তর পচ্চয়ো দিয়ে বুঝানো হয় বিলুপ্তহীনভাবে। রাজার মৃত্যুর পর তার ছেলে রাজ্য শাসন করে। পরবর্তীতে তার ছেলে, তার ছেলে, এভাবে বংশানুক্রমে এটা চলতে থাকে। অনন্তর পচ্চয়ো হচ্ছে বিলুপ্তহীন সাহায্যকারী ধর্ম। আর সংসার বা ভবচক্রও বিলুপ্তহীনভাবে চলতে থাকে। যতক্ষণ না ব্যক্তি এই চক্রের বন্ধন ছেদন করতে সক্ষম হয়। এটা সত্য যে, বুদ্ধ এই কার্যকারণনীতি বা প্রশ্নোত্তর দ্বারা জীবন রহস্য ও জগৎ রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন তবে এ তত্ত্বের মধ্যে জগতের আদি খুঁজতে যাওয়া ঠিক নয় কারণ এ নীতিতে ভগবান বুদ্ধ জগতের আদিতত্ত্ব পরিবেশন করেননি। তথাগত বুদ্ধ জগতের আদিতত্ত্ব অনুসন্ধানকে উম্মাদের কাজ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি মালঙ্ক্যপুত্রকে এই বিষয়ে বিশদ বর্ণনা করেছেন। তথাগত এই বিষয়সমূহ অবর্ণিত অব্যাখ্যাত রেখেছেন। কারণ সেগুলো ধারণা বা মত মাত্র। এতে কোন কল্যাণ সাধিত হয়না, মুক্তির সন্ধান মিলেনা। তাই এই আলোচনায় সময় ব্যয় করা অর্থহীন। এ তত্ত্ব শেষ পর্যন্ত কারো জানাই হয় না, জানতে পারেন না, পরিশেষে অনুতপ্ত অবস্থায় জীবনাবসান হয়।
প্রতীত্যসমুৎপাদ নীতি অত্যন্ত গম্ভীর। জ্ঞান দ্বারা, ব্যবহারিক অনুশীলন দ্বারা এই গম্ভীরতাকে জয় করতে হয়। দীর্ঘনিকায়ের ‘মহানিদান সূত্রে’ দৃষ্ট হয়- আনন্দ তথাগত বুদ্ধকে বলছেন ‘ভন্তে, আশ্চর্য, অদ্ভুত! এই প্রতীত্য-সমুৎপাদ নীতি যেমন গভীর তেমনই গভীররূপে প্রতীয়মান হয়; অথচ আমার নিকট উহা অতি সুষ্পষ্ট।’ তথাগত আনন্দকে পরপর তিনবার নিষেধ করে বললেন- ‘হে আনন্দ! এরূপ বল না। প্রতীত্য-সমুৎপাদ গম্ভীর, গম্ভীর এর দীপ্তি। আনন্দ! এই ধর্ম না জেনে না বুঝে মনুষ্যগণ বিজড়িত তন্তÍুর মতন, জটিভূত সূত্র পিন্ডের মতন, মুঞ্জতৃণগ্রন্থির মতন হয়েছে এবং অপায়, দুর্গতি, অধঃপতন ও সংসারচক্র অতিক্রম করতে পারছে না।’ তথাগতের এ বাক্যের দ্বারা প্রতীত্য-সমুৎপাদের গম্ভীরতা প্রতীয়মান হয়। প্রতীত্যসমুৎপাদ মূলত পালি বইয়ের কোন বিষয় নয়, আবৃত্তিরও কোন বিষয় নয়; এটার অবস্থান আমাদের অভ্যন্তরেই। আর যেখানে এই শৃঙ্খল বিদ্যমান রয়েছে সেখানে দুঃখ ব্যতীত আর কিছুই নেই। নিদানবর্গ সংযুক্তে বলা হয়েছে- কেউ প্রতীত্যসমুৎপাদ চক্রে জীবন কাটাচ্ছে মানে হচ্ছে তিনি মিথ্যা প্রতিপদায় অর্থাৎ ভুল পথে রয়েছেন। আর যিনি বিদর্শনচর্চায় রয়েছেন তিনি সম্যক প্রতিপদায় অর্থাৎ সঠিকপথেই রয়েছেন। যারা বিদর্শন অনুশীলন করেন তারা পুনঃপুনঃ জন্মের শৃঙ্খল ভঙ্গের চেষ্টা করেন। এজন্য বলা হয়ে থাকে যারা বিদর্শন অনুশীলন করেন তারা ‘বেদনা পচ্চযা তণহা’ কে ‘বেদনা পচ্চযা পঞঞা’ তে রূপান্তরের চেষ্টা করেন। বিদর্শন অনুশীলন না করলে বেদনা তৃষ্ণার উৎপাদনই করবে। যারা বিদর্শনচর্চা করে তারা তৃষ্ণাকে প্রজ্ঞায় পরিণত করে।
লেখকঃ সহকারী সম্পাদক, ত্রৈমাসিক ‘অমিতাভ’
সূত্রঃ মধ্যম নিকায় (১ম খন্ড)- শ্রীবেণীমাধব বড়ুয়া অনূদিত মধ্যম নিকায় (২য় খন্ড)- পন্ডিত ধর্মাধার মহাস্থবির অনূদিত বিভঙ্গ-শ্রীমৎ জ্ঞানেন্দ্রিয় ভিক্ষু অনুদিত কার্যকারণ নীতি- ডাঃ প্রিয়নাথ বড়ুয়া, পট্ঠান(সংক্ষিপ্ত)- শ্রী সত্যপ্রসন্ন বড়ুয়া

সুত্র;http://nirvanapeace.com

0 comments:

Post a Comment