Thursday, November 28, 2013

0 শ্রীলংকার বিশ্ববৌদ্ধ যাদুঘরে বাংলাদেশ (১)

আমি বহুবার শ্রীলংকায় গিয়েছি কিন্তু তার সাথে এবারের সফরের একটি পার্থক্য বিদ্যমান। অন্যান্যবার গিয়েছিলাম বৌদ্ধধর্মীয় সম্মেলন, বিশ্ববৌদ্ধ সম্মেলন, বিশ্ব বৌদ্ধ নেতৃসম্মেলন, তথ্যগত অনুসারী সম্মেলন, এশীয় ধর্ম ও শান্তি সম্মেলন ইত্যাদিতে যোগদানের জন্য। এবার গিয়েছিলাম পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে শ্রীলংকার ক্যান্ডিস্থ আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ যাদুঘর পরিদর্শনের জন্য বাংলাদেশের সরকারী প্রতিনিধিদলের সদস্য হয়ে। এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘরের মহাপরিচালক মি. প্রকাশ চন্দ্র দাস মহোদয়, অন্যান্য সদস্যরা হলেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মিসেস শিরীন আখতার। বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের মহাসচিব হিসেবে আমি ড. প্রণব বড়ুয়া এবং বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘরের অফিসার মি. কংকন কান্তি বড়–য়া। অন্যান্যবার শ্রীলংকায় যাই ভারতের মাদ্রাজ হয়ে এবং ব্যাংকক হয়ে, এবার কিন্তু সরাসরি ঢাকা থেকে বিমানে কলম্বো পৌঁছি। এভাবে সরাসরি আর যাওয়া হয়নি। এটা ছিল মিহিনলংকা বিমান-যাত্রার সময় ৩.১৫মি.। অতএব নতুন অভিজ্ঞতা, তার সাথে যুক্ত হলো সরকারী প্রতিনিধিদলের সদস্য হয়ে যাওয়া। মূলতঃ রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনই এ সফর। এ নতুন প্রাপ্তি।
আমরা ৪ঠা এপ্রিল ২০১৩ ইংরেজী তারিখে দুপুর ১২.১৫ মিঃ যাত্রা করি এবং স্থানীয় সময় ৩.১৫ মি. কলম্বো পৌঁছি। বিমান বন্দরে শ্রীলংকাস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা মি. শাকিল আমাদের অর্ভ্যর্থনা জানায়। আমরা মালিডা আন্তর্জাতিক গেষ্ট হাউসে উঠলাম-এটা দূতাবাসের ব্যবস্থাপনা। এখানে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গবেষণা ও সেমিনারের জন্য যারা আসেন তারা থাকেন-নিরাপদ স্থান এবং পরিবেশ ভাল। পৌঁছার পর চেকিং ইন করে কক্ষে গেলাম-হাতমুখ পরিস্কার করে আধঘন্টার মধ্যেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম কলম্বো শহর দেখার জন্য। প্রথমে এলাম স্বাধীনতা পার্কে। এটা খোলা আকাশের নীচে Independence park. নামে পরিচিত। এই পার্কে রয়েছেন মি. সেনানায়েকের বিশাল দন্ডায়মান মূর্তি। তিনি জাতির জনক। ১৯৪৮ সালে বৃটিশ সরকার তার কাছে স্বাধীনতার সনদপত্র যে স্থানে হস্তান্তর করে সেখানে একটি হল আছে। হলের সবদিক খোলা, নির্মাণ শৈলী অনুপম কারুকাজের স্তম্ভগুলি পাথরের। সেনানায়ক হলেন স্বাধীন শ্রীলংকার প্রথম প্রধানমন্ত্রী। বিশাল চত্বরে অনেক ভ্রমনপিপাসু এসেছেন। আমরাও চলে যাই সমুদ্র সৈকতে। শ্রীলংকাকে ভারত মহাসাগর স্পর্শ করেছে। সেখানে আমার পুরানো স্মৃতি মনে পড়ল। কেননা যে তাজসমুদ্র হোটেলে আমি ছিলাম তার সম্মুখেই তো সৈকত। এখানে আরও অনেক হোটেল আছে-সেখানেও থেকেছি। সৈকতে মহাসাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। ফুরফুরে বাতাস। বেশ ভাল লাগল, সকলেই উপভোগ করলাম। সৈকত জুড়ে খাওয়ার দোকান। বাচ্চারা ঘোড়ার পিটে চড়ে বেড়াচ্ছে।
সবশেষে এলাম দূতাবাসের কাউন্সিলর মি. বোরহান সাহেবের বাসায়। এখানে আমাদের ডিনার হবে। ঐ ডিনারের মাননীয় হাই কমিশনার মি. সাফিউর রহমান সাহেবও যোগদান করে। দূতাবাসের অন্যান্য কর্মকর্তারা ও যোগদান করে-তাদের স্ত্রীপুত্রসহ। সবাই যখন একত্রিত হলাম মনে হল বাংলাদেশেই আছি। মাননীয় হাইকমিশনারের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ হল। বিশেষত: ক্যান্ডি যাদুঘরে বাংলাদেশ গ্যালারীর সাজসজ্জা নিয়ে, তাকে খুবই আন্তরিক দেখলাম। মূলতঃ তারই পরামর্শে এই সফর অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তিনি রংপুরের অধিবাসী অভিজ্ঞ কূটনৈতিক ব্যক্তিত্ব। আমি তার সাথে আলাপ করে খুবই আনন্দিত ও উপকৃত হয়েছি। এই ডিনারে বাংলাদেশের শ্রীলংকা নিবাসী শ্রীমৎ তাপস ভিক্ষুও যোগদান করে। সে আমার আমন্ত্রনে আমার সাথে দেখা করার জন্য আসে। কিন্তু ভাল লাগল এই দেখে যে, তাপস ভিক্ষু মাননীয় হাইকমিশনারসহ দূতাবাসের প্রত্যেকের সাথে অতি পরিচিত। তারাও তাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছে। আমি বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সাথে তাপস ভিক্ষুকে পরিচয় করিয়ে দিলাম। আমাদের সংগঠনের অন্যতম কর্মী হিসেবে। তাপস ভিক্ষু শুধু জুস খেল। ডিনারের পর অতিথি ভবনে ফিরে আসি। আগামীকাল সকাল ৭.৩০ টায় আমরা ক্যান্ডি যাবো। তাই ঘুমের প্রয়োজন। তদপুরি সারাদিনের ক্লান্তিও বিশ্রাম চাইছিল।
আজ ৫ই এপ্রিল Guest House এর ক্যাফেটেরিয়ায় প্রাত:রাশ খেয়ে আমরা কলম্বো থেকে ক্যান্ডির উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। সাথে মি. শাকিল ও তাপস ভিক্ষু। ভাল ক্যাফেটিরিয়া, পরিচ্ছন্ন এবং খাদ্যও ভাল। রাস্তাভাল কিন্তু অনেকটা পাহাড়ী পথ বলে আমরা ৮টায় রওনা হলে ক্যান্ডি পৌঁছলাম সকাল ১১.৩০ টায়। আমাদের অভ্যর্থনা জানায় শ্রীলংকা প্রতিনিধিদলের নেতা প্রফেসর লীলানন্দ প্রেমাতিলক-সাথে ছিলেন অপর দুই সদস্য মি. গামিনী ভান্ডারা ও মি. লিওনেল উইজেসুন্দরা। দলনেতা প্রবীন ব্যক্তি এবং খুবই অভিজ্ঞ-তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পালিতে এম. এ করেছেন। ড. বেনীমাধব বড়–য়াকে চেনেন, ড. নীহার রঞ্জন রায় ও অতি পরিচিত। পরে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি.এইচ. ডি করেছেন। আমি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি. এইচ. ডি করেছি জেনে তিনি আনন্দিত হলেন। প্রাথমিক আলাপের পর আমরা আন্তর্জাতিক বৌদ্ধধর্মীয় যাদুঘর দেখতে গেলাম। যাদুঘরে নীচের তলায় বাংলাদেশ গ্যালারী-শুরুতেই পেলাম ভারত, তারপর বাংলাদেশ, এরপর হচেছ নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভিয়েতনাম, লাওস, শ্রীলংকা, মায়ানমার, থাইল্যান্ড-উপরের তলায় আছে ইন্দোনেশিয়া, মালেয়েশিয়া, দঃ কোরিয়া, চীন ও জাপানের গ্যালারী।

ভারী দৃষ্টিনন্দন গ্যালারীগুলি স্ব দেশের বৌদ্ধ ঐতিহ্য ও সভ্যতার-পরিচয় তুলে ধরছে। বাংলাদেশ গ্যালারীটা বর্তমানে সাজানো হয়েছে। আমাদের পরিদর্শনের উদ্দেশ্য হল কি করে একে আরও আকর্ষনীয় ও মানসম্পন্ন করা যায়। গ্যালারীটা করিডোরে হওয়াতে আমার ভাল লাগেনি। আমাদের দলনেতা তার অসন্তুষ্ঠির কথা জানান। শ্রীলংকা কর্তৃপক্ষ বলেন প্রয়োজনে দেয়াল ভেঙ্গে বাংলাদেশের গ্যালারীর জন্য আরও জায়গা করে দেবে। পরিদর্শনের পর আমরা আনুষ্ঠানিক ভাবে বৈঠক করি এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিই। বাংলাদেশের প্রাচীন মূর্তিগুলির ছবির চাইতে রেপিকার উপর জোর দেওয়া হয়। একটি বাংলাদেশের মানচিত্র থাকবে এবং সেখানে বৌদ্ধঐতিহ্যভরা স্থানগুলিকে চিহ্নিত করে দেখান হবে। প্রবেশ পথে একটি বৌদ্ধ ঐতিহ্যবাহী তোরন থাকে। প্রবেশ করে দেখানো হবে বড় রেপিকায় পাহাড়পুর বৌদ্ধ মহাবিহারকে। প্রতিটি প্রদর্শনীতে তিনটি ভাষা থাকবে-সেগুলিতে বাংলা, সিংহলী ও ইংরেজীতে বর্ণনা থাকবে। বড় ভাস্কর্য থাকবে বজ্রপানি, ধ্যানীবুদ্ধ, অবলোকতিশ্বর এবং পালযুগের মূর্তিগুলির। কিছু কিছু চিত্রকর্ম ও থাকতে পারে। তাছাড়াও পাহাড়পুর ময়নামতি, রোহিতগিরি, পুন্ডবর্দ্দনের পরিচিতি থাকবে। আলাপের মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধেয় প্রকাশ চন্দ্র দাস ও শ্রদ্ধেয়া শিরীন আখতারের মেধা মনন ও জ্ঞানের পরিচয় পেয়েছি-আমার বিশ্বাস তাদের মাধ্যমে বিদেশের মঞ্চে বাংলাদেশের ঐতিহ্য বেশ ভালভাবেই প্রতিপলিত হবে। যে জিনিসটার উপর জোর দেয়া হয়েছে সেটা হল বাংলাদেশের ভৌগলিক পরিচয়।
বাংলাদেশের বৌদ্ধধর্মের আগমন, অশোক যুগ, পুষ্যমিত্র, শশাংক ও গুপ্তযুগের বৌদ্ধধর্ম। বৌদ্ধধর্মেই পৃষ্ঠপোষকতা, হিউয়েসান ও ফাহিয়েনের সময়ের বৌদ্ধধর্ম। বিভিন্ন বৌদ্ধ রাজবংশ, পালরাজবংশ, বাংলাদেশে মহাযানী বৌদ্ধধর্ম তার উত্থান ও পরিণতি-দ্বাদশ শতকের পরের অন্ধকার যুগ ও আধুনিক যুগের বৌদ্ধধর্মের উপর একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। এর বাইরেও বাংলাদেশ সরকার, জাতীয় যাদুঘর ও প্রত্মতত্ত্ব বিভাগ আরও আকর্ষনীয় বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে। আলোচনা খুবই সফল হয়েছে এবং আমি মনে করি এ ধরনের মতবিনিময় সভা বড়ই প্রয়োজন ছিল। এজন্য শ্রীলংকায় নিযুক্ত বর্তমান মাননীয় হাইকমিশনারের উদ্যোগ প্রশংশনীয় এবং তাতে সাড়া দেয়ার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অভিনন্দন জানাচ্ছি।

কৃতজ্ঞতাঃhttp://www.nirvanapeace.com
  

0 comments:

Post a Comment