যুগে
যুগে বঙ্গ বা বাঙালি শব্দকে ঘিরে সুজলা-সুফলা অস্তিত্বকে কবি, সাহিত্যিক ও
ঐতিহাসিকরা ভাবের ব্যঞ্জনায় প্রকাশিত করে আসছেন। ইবনে বতুতা, আলবেরুণী,
টলেমী ও চৈনিক পর্যটকগণ বাংলার ঐশ্বর্য ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ না হয়ে পারেননি।
কিন্তু সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক সময় আক্ষেপ করে
বলেছিলেন “বাঙালির ইতিহাস নাই”। সত্যিকার অর্থেই আমরা বাঙালিরা ইতিহাস
জিজ্ঞাসু নই। আর তাই কালের করাল গ্রাসে এই নশ্বর পৃথিবীর সবকিছুই অবক্ষয়ের
পথে এগিয়ে যায়। আমরা যদি একটু সচেতন হই তাহলে আমাদের চারপাশের পুরনো
ঐতিহ্যমণ্ডিত স্থান বা প্রতিষ্ঠানসমূহের ইতিহাস সংগ্রহ করে আমরা নিজেদের
সভ্যতার ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করতে পারি যা যুগে যুগে প্রেরণার উপকরণ হিসেবে
সৃজনশীল কাজে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। আমরা একটু দৃষ্টি দিই আদি
বৌদ্ধতীর্থ চক্রশালার দিকে।
দক্ষিণ
চট্টগ্রামের অগ্রসরমান জনপদ পটিয়া। পটিয়া সদর থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার
পূর্বে এর অবস্থান। বৌদ্ধযুগে চট্টগ্রামের আদি নাম ছিল চট্টলা। তবে এটি
চক্রশালা নামেই বহির্জগতে সমধিক পরিচিত ছিল এবং এখনো বিদ্যমান। বর্তমানে এই
চক্রশালা গ্রামটি এর ক্ষীণ স্মৃতি বহন করে বৈকি। পূর্বে এ স্থানে শুধু
একটি মন্দির ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সেই মন্দিরের গায়ে মার্বেল পাথরে খোদাই
করে লেখা আছে, “ফরাতারা স্তুপ নবতর পর্যায়ে সংস্কার ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দ
চক্রশালা বৌদ্ধতীর্থ সংরক্ষণ কমিটি হাইদগাঁও, পটিয়া, চট্টগ্রাম।”
পর্যায়ক্রমে এ স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে একটি সুদৃশ্য তোরণ ও সীমানা
প্রাচীর। এছাড়া এ মন্দিরের পূর্বদিকে রয়েছে একটি পাকাঘাটসমেত পুকুর ও
টিউবওয়েল। বলাবাহুল্য এ মন্দিরের আশেপাশে এমনকি হাইদগাঁও ও চক্রশালা
গ্রামের কোথাও বৌদ্ধ পরিবারের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু
জনশ্র“তি আছে এখানে একসময় বৌদ্ধদের বাস ছিল যা কালক্রমে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
এই
চক্রশালা নামের উৎপত্তি নিয়ে নানা মহলের কাছ থেকে নানা ধরনের তথ্য পাওয়া
যায়। শোনা যায় এ স্থানে তথাগত গৌতম বুদ্ধ সুদূর রেঙ্গুন (মিয়ানমার) থেকে
আসার পথে অবকাশ যাপন করেন এবং তিনি চংক্রমন করেছিলেন বলেই এই স্থানটিকে
চক্রশালা নামে অভিহিত করা হয়। কেউ কেউ বলেন চক্রশালায় বুদ্ধের বত্রিশ লক্ষণ
ও অশীতি অনুরঞ্জন অঙ্কিত বুদ্ধচক্র নামক পাথর, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের
প্রধান আচার্য শীলভদ্র মহাস্থবিরের শিষ্য দীপঙ্কর স্থবির কর্তৃক এ মন্দির
প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেজন্য একে চক্রশালা বলা হয়। উল্লেখ্য, তিব্বতের
তাঞ্জুর গ্রন্থেও চক্রশালার ইতিবৃত্ত লিপিবদ্ধ আছে জানা যায়। তবে ভদন্ত
ধর্মতিলক ও বীরেন্দ্র মুৎসুদ্দী কর্তৃক অনুবাদিত সদ্ধর্ম রত্নাকর গ্রন্থে
যা লিপিবদ্ধ আছে সে তথ্যগুলোকেই সর্বাপেক্ষা শ্রেয় বলে বিবেচনা করা হয়। তা এ
রকমÑ চট্টল বৌদ্ধগণের পৌরাণিক ইতিবৃত্ত ধারাবাহিকভাবে লিপিবদ্ধ না থাকলেও
শ্র“তি পরম্পরা ইতিবৃত্ত সম্বন্ধে অভিজ্ঞ প্রাচীনদের মতে চট্টল বৌদ্ধদের
আদি পুরুষ মগধ হতে এসেছে। ছান্ধমা নামে এক ব্যক্তি মগধ দেশ হতে এসে প্রথমে
আকিয়াবের ছান্ধমা পাহাড়ে উপনিবেশ স্থাপন করেন। তাঁর নামানুসারে সেই পাহাড়ের
নাম ছান্ধমা নামে আজো পরিচিত। তিনি সেই পাহাড়ের শীর্ষে এক মনোরম ধাতুচৈত্য
নির্মাণ করেন। প্রবাদ আছে সেই ধাতুচৈত্য হতে সময়ে সময়ে জ্যোতি নির্গত হয়। ঐ
আদিপুরুষ ছান্ধমার চেন্দি ও রাজমঙ্গল নামে দুই পুত্র ছিল। চেন্দি ছিলেন
গৃহী আর রাজমঙ্গল ভিক্ষুধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। গৃহী চেন্দীর ঔরসে কেজগ্রি,
কেয়ক্চু ও বৃন্দাবন নামে তিনটি সন্তানের জন্ম হয়। তাদের বাসস্থান ছিল
কক্সবাজারের চকরিয়া গ্রামে। তাদের মধ্যে কেয়ক্চু মগধবাসী দীপঙ্কর
মহাস্থবিরের শিষ্য সরভূ মহাস্থবিরের নিকট ভিক্ষুত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তখন
তাঁর নামকরণ হয়েছিল চন্দ্রজ্যোতিঃ।
এরপর
তিনি দেশপরিভ্রমণ ও শিক্ষালাভের মানসে ব্রহ্মদেশের মৌল মেইনে গমন করেন।
সেখানে বিশ বছর যাবত ধর্ম, বিনয় অধ্যয়ন করে দেশে ফেরার সময় সেদেশের দশজন
ভিক্ষুসহ একটি চক্রাসন, তিনটি বুদ্ধমূর্তি ও কয়েক খণ্ড বুদ্ধাস্থি
এনেছিলেন। উল্লেখ্য, সেই বুদ্ধমূর্তিগুলো আনয়নের সুবিধার জন্য তিন টুকরা
অবস্থায় আনা হয়েছিল বলে ত্রিভঙ্গ মূর্তি নামে কথিত রয়েছে। মূর্তিগুলোর
শিরোপরি বুদ্ধের শারীরিক অস্থিধাতু স্থাপিত ছিল। তাঁরা আগরতলার লালমাই
পাহাড়ে বিহার স্থাপন করেন। আগরতলা রাজবংশীয় বলিভীম আদিত্য নামক জনৈক
শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তি তাঁদের জন্য বিহার নির্মাণ করে সেখানে চৌদ্দ হাত লম্বা
পরিনির্বাণ মূর্তি ও বিনয়ানুকুল ভিক্ষুসীমা নির্মাণ করেছিলেন। সেই সীমায়
ক্রমে ১০০ জনকে ভিক্ষুধর্মে দীক্ষা দেওয়া হয়েছিল। সেখানে পাঁচ বৎসরকাল
শিষ্যদেরকে ধর্মবিনয় শিক্ষা দিয়ে চট্টগ্রাম অভিমুখে ফিরছিলেন, ফেরার পথে
সীতাকুন্ড পাহাড়ের উচ্চতম শিখরে একটি বিহার স্থাপন করেন। সেখানে পূর্বোক্ত
ত্রিভঙ্গ বুদ্ধমূর্তি স্থাপনপূর্বক একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকে
সীতাকুন্ড পাহাড় ভিক্ষু চন্দ্রজ্যোতিঃ বিহারের নামানুসারে চন্দ্রশেখর নামে
পরিচিত হয়ে আসছে।
এরপর
তিনি শিষ্যগণসহ পটিয়ার পর্বত নির্ঝরণী শ্রীমতির তীরে হাইডমজা নামক ধনাঢ্য
ব্যক্তির আম্রকাননে উপস্থিত হন। হাইডমজা খবর পেয়ে প্রতিবেশীসহ চন্দ্রজ্যোতি
স্থবিরকে দেখতে যান। তিনি স্থবিরের পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলাপে সন্তুষ্ট হয়ে
তাঁকে আপন বিহারে নিয়ে যান এবং তিন দিনব্যাপী ধর্মসভার আয়োজন করেন। হাইডমজা
কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলেন যে, এই স্থবির কক্সবাজারের চকরিয়া নিবাসী
চেন্দির পুত্র। অতঃপর তিনি এ সংবাদ নিয়ে চকরিয়াতে লোক পাঠালেন। চেন্দি
নিরুদ্দেশ পুত্রের খবর পেয়ে খুবই পুলকিত হলেন এবং অনেক লোকজন সমভিব্যহারে
গিয়ে পুত্রকে স্বদেশে ফিরিয়ে আনেন।
চকরিয়াতে
রওয়ানা হবার সময় হাইডমজা চন্দ্রজ্যোতি স্থবিরের নিকট চক্রাসনটি প্রার্থনা
করেন। স্থবিরও তা তাকে সানন্দে প্রদান করেন। এই চক্রাসন স্থাপনের জন্য
হাইডমজার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় নিজ গ্রামের কেন্দ্রে যে মন্দির নির্মিত
হয়েছিল, তা-ই চক্রশালা মন্দির। চক্রাসন স্থাপনের জন্য এই এলাকাটি
“চক্রশালা” নামে পরিচিত হয়ে আসছে। এরপর স্থবির পুনরায় তার পিতাসহ এই এলাকায়
চক্রাসনের মন্দির বন্দনার মানসে উপস্থিত হন। সেখানে বন্দনা, পূজা করে
বিষুব সংক্রান্তিতে মেলার আয়োজন করেন। সেই থেকেই প্রতি বছর এই স্থানে চৈত্র
মাসের শেষদিন অর্থাৎ বিষুব সংক্রান্তিতে মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
কালের
বিবর্তনে চক্রশালা আদি বৌদ্ধ তীর্থ মন্দিরটি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে
পরলোকগত সংঘরাজ পূর্ণাচার ধর্মাধার চন্দ্রমোহন মহাস্থবির ও প্রতœতত্ত্ব
বিশারদ জগতচন্দ্র মহাস্থবিরের প্রয়াসে পুনঃনির্মিত হয়। দ্বিতীয়বারে পটিয়ার
বাক্খালী গ্রামের প্রয়াত নবীন চন্দ্র বড়–য়ার উদ্যোগে সাধারণের
অর্থানুকুল্যে মন্দিরটি সংস্কার করা হয় এবং সাতবাড়িয়ার প্রয়াত অধীন চন্দ্র
চৌধুরী মন্দিরের সম্মুখস্থ পুকুরের পক্ষোদ্ধার করেন। স্বাধীনতা পরবর্তী
সময়ে পটিয়ার মধ্যম জোয়ারা গ্রামের প্রয়াত মনোরঞ্জন বড়ুয়া নিজ ব্যয়ে পুকুরের
ঘাট নির্মাণ ও টিউবওয়েল স্থাপন করেন।
বিষুব
সংক্রান্তির মেলায় এই মন্দিরের প্রাঙ্গণ জুড়ে হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধ
জনসাধারণের সমাগম ঘটে। কিন্তু দুঃখের বিষয়Ñ এ স্থানে যাতায়াতে চরম দুর্ভোগ
পোহাতে হয়। পটিয়া সদর থেকে কিছুদূর রাস্তা কার্পেটিং করা থাকলেও বাকী
মাত্র ১ কিলোমিটার রাস্তা সম্পূর্ণ কাঁচা ও অত্যন্ত সরু অবস্থায় রয়েছে।
এলাকাবাসী তথা ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধ জনসাধারণের দাবী এ সড়কের দ্রুত সংস্কার।
আমাদের প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব এরকম ঐতিহ্যমণ্ডিত স্থানের গুরুত্ব
অক্ষুন্ন রাখতে উদ্যোগী হওয়া। এজন্য প্রয়োজনীয় প্রকল্পসমেত উদ্যোগ গ্রহণে
সরকারী অনুদান ও জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসা
একান্ত অপরিহার্য। না হয় প্রাচীন বৌদ্ধসভ্যতার নিদর্শন এই অতীত গৌরব
বিস্মৃতির অতলগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।
0 comments:
Post a Comment