Wednesday, November 27, 2013

0 বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ও পরিণতি

‘বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি, ধম্মং সরণং গচ্ছামি, সংঘং সরণং গচ্ছামি’ - এই মন্ত্রই বৌদ্ধধর্মের মূলমন্ত্র। কোটি কোটি মানুষ এই মন্ত্রোচ্চারণ করে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন। ভগবান বুদ্ধ নির্দেশিত শীলাচারণ, মঙ্গলপ্রার্থনা তথা তাঁর সমগ্র জীবনই এই ধর্মে দীক্ষিত হলে যে প্রভাবিত করে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আপন মুক্তি বুদ্ধের প্রার্থনা ছিল না -বৃহত্তর জগতের স্বার্থে আপামর জনসাধারণের মুক্তির উপায় খুঁজতে এই করুণাঘন মহামানবের আবির্ভাব। তাঁর ব্যক্তিগত সংযম, সৌন্দর্র্য। গাম্ভীর্যপূর্ণ সুভাষণ অচিরেই জয় করে নিয়েছিল সহস্র শরণাগতের হৃদয়।
ঈশ্বর ও পরকালে বিশ্বাস মানবধর্মের ভিত্তি কিন্তু তা সত্তেও অনাত্মবাদী নিরীশ্বর বৌদ্ধধর্মের দেশে- বিদেশে প্রসার ঘটেছে। তাঁর ধর্মচক্রপ্রবর্তন-সূত্র থেকেই এই নিরীশ্বরবাদের পরিচয় মেলে। ধর্মচক্র-প্রবর্তন বুদ্ধের প্রথম উপদেশ যাতে ঈশ্বর বিষয়ক কোন প্রসঙ্গ আলোচিত হয় নি, যা হয়েছে তা হলো দুঃখতত্ত্ব। দুঃখ কি? দুঃখের উৎপত্তি কোথায়? দুঃখের নিবৃত্তি কিসে হয় এবং দুঃখ নির্বত্তির উপায় যা ‘আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ’ নামে পরিচিত। এই প্রদর্শিত পথাবলম্বনেই ধর্মের চরম লক্ষ্য নির্বাণ বা মুক্তি সম্ভব। বৌদ্ধধর্মের সারকথা হলো যে প্রত্যেক মানুষ নিজ কর্মগুণে, নিজ পুণ্যবলে, স্বার্থবিসর্জন, সদাচার, প্রেম, মৈত্রী, করুণার দ্বারা নির্বাণরূপ মুক্তিলাভের অধিকারী হয়। বিবেচনা করে বলা যায় বৌদ্ধধর্ম কোন ঈশ্বরবাদ নয় - এটি নীতিমূলক বা নীতিপ্রধান ধর্ম। যে নীতে বা নিয়ম তিনি সঙ্ঘের জন্য নির্দিষ্ট করেছিলেন তার অনেকাংশই সাধারণ মানুষেরও আত্মার শুদ্ধিকরণে যে যথেষ্ট সহায়ক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাছাড়াও ভগবান তার এই নীতি ধর্ম গল্পের মাধ্যমে যে সুন্দরভাবে প্রচার করতেন তাও বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সহজ প্রাঞ্জর ভাষা, সময়োপযোগী প্রসঙ্গ, যুক্তিসহকারে যেভাবে তিনি পরিবেশন করতেন যা সুবোধ্য প্রাণস্পর্শী হয়ে উঠতো সহজেই। আগ্রহ পূর্বক তা শ্রবণ করে মানুষ ক্রমেই এই ধর্মের দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকে। এছাড়াও ভগবানের অকৃত্রিম সরলতা, গাম্ভীর্য ও মনোমুগ্ধকারী মোহিনীশক্তি, আকর্ষণী ক্ষমতা তাঁর ধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটায় খুব অল্প সময়ের মধ্যে।

বৌদ্ধধর্ম জনপ্রিয়তা পাওয়ার আর একটি প্রধান কারণ হলো- শাক্যমুনি যখন আবির্ভূত হন তখন ব্রাক্ষণ্য ধর্মের বৈদিক পূজার্চনা, যাগযজ্ঞের জটিল ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপ ও বাহ্যিক আড়ম্বর এবং ব্রাক্ষণদের আদিপত্য ও জাত্যাভিমান মানুষের মধ্যে ব্রাক্ষাণ্যধর্মের প্রতি যেমন বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি করে তেমনই বৌদ্ধধর্মের সরলতা, অহিংসা, ক্ষমার আদর্শ এবং জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে আপামর জনসাধারণের প্রতি সাদর আমন্ত্রণের ডাক মানুষকে বৌদ্ধধর্মের প্রতি নিবিড়ভাবে আকৃষ্ট করে তোলে। সর্বোপরি তাঁর (ভগবান বুদ্ধ) জীবনরহস্য ও হৃদয়স্পর্শী অসাধারণ আকর্ষণ শক্তি বা ক্ষমতার কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না
বৌদ্ধসংগীতিগুলি বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে এক একটি অধ্যায় বিশেষ। আনুমানিক ৪৮৩ খ্রীঃ পূ. ভগবান নির্বাণলাভ করার কয়েক মাসের মধ্যেই বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়। কোন্ ধর্ম-বিনয়গুলি গৃহীত, পালিত বা অনুসৃত হবে বা কোন্গুলি হবে না এই প্রসঙ্গ দেখা দিলে বুদ্ধবাণী সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। ক্রমে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বৌদ্ধসংগীতি যথাক্রমে আজাতশত্র“, কালাশোক, অশোক ও সম্রাট কণিষ্কের রাজত্বকালে অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম সংগীতিতে ধর্ম ও বিনয় আলোচিত হয় এবং সংস্থাপিত হয়। এই অধিবেশনে ত্রিপিটকের অন্যশাখা অভিধর্মের অস্থিত্ব মেলে না। বৌদ্ধসংঘে দশবস্তু (দসবত্থু) নিয়ে যে বিরোধ উপস্থিত হয়েছিল তা মীমাংসা করার জন্য দ্বিতীয় বৌদ্ধসংগীতি অনুষ্ঠিত হয় এবং এই সংগীতি বৌদ্ধর্মের আরও প্রসার ঘটায় এবং বিভিন্ন শাখা-উপশাখা উদ্ভবের ফলে বৌদ্ধসংঘ বি¯তৃতিলাভ করে। তবে কথিত আছে লব্ধ সুযোগ সুবিধা বৌদ্ধ ভিক্ষুদেও সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য মতাবলম্বীদেরও সংঘে প্রবেশ করতে আগ্রহ সঞ্চার করে এবং বৌদ্ধ বিহারগুলিতে বিভিন্ন মত প্রচারের ফলে যথার্থ ধর্মের প্রসারে বিঘ্ন ঘটে এবং সংঘে অত্যন্ত বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। মৌর্য সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় বৌদ্ধ সংগীতিতে প্রথম অভিধর্মের উল্লেখ পাওয়া যায় এবং ‘কথাবত্থুপ্পকরণ’ নামক অভিধম্মপিটকের গ্রন্থটি সংকলিত হয় এবং সাথে সাথে সদ্ধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতে সসাগরা পৃথিবী প্রকম্পিত হয়। এছাড়াও অশোকের অনুশাসনগুলিও বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও মানুষের নৈতিক চরিত্রের উন্নতিসাধনে যথেষ্ট সচেষ্ট হয়েছিল। চতুর্থ বৌদ্ধ সংগীতি নিয়ে নানা মতানৈক্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্য থাকলেও সম্রাট কণিম্বের রাজত্বকালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ সংগীতিতেই যে বৌদ্ধসংঘের বাক্- বিতণ্ডা ও বিশৃঙ্খলতার নিষ্পত্তি ঘটেছিল তা অধিকাংশে স্বীকৃত হয়। সংগীতির অধিবেশনের সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই বৌদ্ধগ্রন্থসমূহের লিখিত রূপ প্রত্যক্ষ করা যায়। বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে সংগীতিগুলির গুরুত্ব যে অপরিসীম তা বলাই বাহুল্য।
‘বয়ধম্মা সংখারা’ অর্থাৎ ‘সকল উৎপন্ন বস্তুই বিনাশশীল’ বুদ্ধের এই মত তাঁর ধর্ম সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। যে ধর্মের দেশে-বিদেশে এত প্রসার ও প্রতিপত্তি, যার প্রভাবে ভারতীয় সংস্কৃতি ও সাধনা বহুদূর দেশে বি¯তৃতিলাভ করে সত্যতার আলোকদান ও নবপ্রাণ সঞ্চার করেছে ভারতবর্ষ থেকে সম্পূর্ণ লুপ্ত না হলেও তা ক্রমে অবলুপ্তির পথে কেন পা বাড়িয়েছে তা আলোচনা সাপেক্ষ।
সব ধর্মই তা যতই মহান হোক না কেন অনুকূল পরিবেশেই তা বিস্তারলাভ করে এবং বৌদ্ধধর্মের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা ঘটেনি। বুদ্ধের জীবদ্দশাতেই বৌদ্ধধর্ম ব্যাপক প্রসারলাভ করলেও খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে মৌর্য সম্রাট অশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় তা প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষে তথা বহির্বিশ্বে বিস্তারলাভ করে এবং পৃথিবীর বুকে এক অন্যতম ধর্মরূপে প্রতীয়মান হয়। বস্তুতঃ এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা- তিনটি মহাদেশেই অশোক প্রেরিত ধর্মপ্রচারকগণ ধর্ম প্রচারার্থে গমন করেন। বহির্বিশ্বে বৌদ্ধধর্ম যেমন দক্ষিণে সিংহল (শ্রীলঙ্কা), ব্রক্ষদেশ (মায়ানমার), শ্যামদেশ (থাইল্যাণ্ড), কম্বোডিয়া, চম্পা (ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া জাভা, সুমাত্রা, বালি, বোর্ণিও) প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে পড়ে তেমনি উত্তরে অর্থাৎ মধ্য এশিয়া (কাশগড়, কুছ, তুরফান, খোটান) তিব্বত, চীন, কোরিয়া, জাপান ও মঙ্গোলিয়াতেও প্রভূত বিস্তৃতি লাভ করেছে।

0 comments:

Post a Comment