Tuesday, December 3, 2013

0 বুদ্ধের বাণী - স্বামী বিবেকানন্দ ।

আমি সারা জীবন বুদ্ধের অত্যন্ত অনুরাগী, ….. অন্য সব চরিত্রের চেয়ে এঁর চরিত্রের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা অধিক। আহা, সেই সাহসিকতা, সেই নির্ভিকতা, সেই গভীর প্রেম ! মানুষের কল্যানের জন্যই তাঁর জন্ম ! সবাই নিজের জন্য ঈশ্বরকে খুঁজছে, কতলোকই সত্যানুসন্ধান করছে ; তিনি কিন্তু নিজের জন্য সত্যা লাভের চেষ্টা করেননি। তিনি সত্যের অনুসন্ধান করেছেন মানুষের দুঃখে কাতর হয়ে। কেমন ক'রে মানুষকে সাহায্য করবেন, এই ছিল তাঁর একমাত্র চিন্তা। সারা জীবন তিনি কখন নিজের ভাবনা ভাবেননি। এত বড় মহৎ জীবনের ধারনা আমাদের মতো অজ্ঞ স্বার্থান্ধ সঙ্কীর্ণ চিত্ত মানুষ কি ক'রে করতে পারে ?......
তারপর তাঁর আশ্চর্য বুদ্ধির কথা ভেবে দেখ। কোনরকম ভাবাবেগ নেই । এই বিশাল মস্তিষ্কে কুসংস্কারের লেশও ছিল না। প্রাচীন পুথিতে লেখা আছে, পিতৃপুরুষদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া গেছে, অথবা বন্ধুরা বিশ্বাস করতে বলছে-এই সব কারণে বিশ্বাস ক'রো না ; তুমি নিজেই বিচার করে দেখ, নিজেই সত্যানুসন্ধান কর ; নিজেই অনুভব কর। তারপর যদি তুমি তা অন্যের বা বহুর পক্ষে কল্যানপদ মনে কর, তখন তা মানুষের মধ্যে বিতরণ কর। কোমলমস্তিষ্ক ক্ষীণমতি দুর্বলচিত্ত কাপুরুষেরা কখন সত্যকে জানতে পারে না। আকাশের মতো উদার ও মুক্ত হওয়া চাই। চিত্ত হবে নির্মল স্বচ্ছ, তবেই তাতে সত্য প্রতিভাত হবে। কি কুসংস্কার রাশিতে পরিপূর্ণ আমরা সবাই! তোমাদের দেশেও, যেখানে তোমরা নিজেদের খুবই শিক্ষিত বলে ভাবো, কী সঙ্কীর্ণতা আর কুসংস্কারে আচ্ছন্ন তোমরা! ভেবে দেখ তোমাদের এত সভ্যতার গর্ব সত্ত্বেও আমি নিতান্ত হিন্দু বলেই কোন এক অনুষ্টানে আমাকে বসতে আসন দেওয়া হয় নি।.....
খ্রীষ্টের জন্মের ছ-শ বছর আগে, বুদ্ধ যখন জীবিত ছিলেন, ভারতবাসীরা অবশ্যই আশ্চর্য রকম শিক্ষিত ছিল ; নিশ্চই তারা উদার ছিল। বিশাল জনতা বুদ্ধের অনুগামী হয়েছিল, নৃপতিরা সিংহাসন ত্যাগ করেছিলেন, রানীরা সিংহাসন ছেড়ে দিয়ে এসেছিলেন। জনসাধারণ সকলেই তাঁর উপদেশগুলি সমাদর ক'রে গ্রহন করতে পেরেছিল, কারণ তাঁর শিক্ষা এত বিপ্লবাত্মক ছিল, এবং যুগ যুগ ধরে প্রচারিত পুরহিতদের শিক্ষার চেয়ে বিভিন্ন ছিল! অবশ্য তাদের মনও ছিল উন্মুক্ত ও প্রশস্ত, যা সচারাচর দেখা যায় না।…………………………………………………
এমন কি অন্তিম কালেও তিনি নিজের জন্য কোন প্রতিষ্ঠা দাবী করেননি। এই কারণেই আমি তাঁকে শ্রদ্ধা করি। বুদ্ধ ও খ্রীষ্ট হচ্ছেন উপলব্ধির এক একটির অবস্থার নামমাত্র। লোকশিক্ষাকদের মধ্যে বুদ্ধই আমাদের আত্মা-বিশ্বাসী হ'তে সবচেয়ে বেশী ক'রে শিক্ষা দিয়েছেন, শুধু মিথ্যা 'অহং' -এর বন্ধন থেকে আমাদের মুক্ত করেননি, অদৃশ্য ঈশ্বর বা দেবতাদের উপর নির্ভররতা থেকেও মুক্ত করেছেন। মুক্তির সেই অবস্থা-যাকে তিনি নির্বাণ বলতেন, তা লাভ করবার জন্য প্রত্যেককেই আহ্বান করেছিলেন। একদিন সে-অবস্থায় সকলেই উপনীত হবে; সেই নির্বাণে উপনীত হওয়াই হচ্ছে মনুষ্য-জীবনের চরম সার্থকতা।


( ১৯০০ খৃঃ ১৮ই মার্চ স্যান ফ্রান্সিস্কোতে প্রদত্ত ভাষণের কিছু অংশ )
 

0 comments:

Post a Comment